• ঢাকা
  • বুধবার, ৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২ আগস্ট, ২০২৪
আপডেট : ২ আগস্ট, ২০২৪



নিহত শিশু শাওনের বাবা মা ‘কে শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা গ্রামবাসী

গ্রামীণ কণ্ঠ

লক্ষ্মীপুর: ওরে আমার বুকের মানিক কেরে কেড়ে নিলোরে ? আমি কি করে বাঁচুমরে? আমার ছেলের কি অপরাধ ছিলোরে? তোরা আমার মানিকরে ফিরিয়ে দে-রে, আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছেরে”এই ভাবে আরো নানা হৃদয় কাড়া কথা তুলে ধরে বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির কাছের চায়ের দোকানে বসে কাঁদছেন ঢাকায় কোটা আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোর দোকান কর্মচারি মোঃ ইউনূছ আলী শাওন (১৭) এর হত দরিদ্র পিতা বৃদ্ধ আবুল বাশার। তার কান্নায় হৃদয়ও যেন গলে যায়। আবুল বাশারের কান্নার সাথে সাথে গ্রামের দোকানে উপস্থিত ছোট বড় সকলেরই চোখের পানি দেখা যায়।
উপস্থিত সকলেই জানান, পুত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে শুনার পর থেকে এভাবেই কেঁদে চলছেন আবুল বাশার। কিছুতেই তার এই কান্না থামানো যাচ্ছেনা।
কোটা আন্দোলনে নিহত নিরীহ মানুষের একজন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ মাগুরী গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের কিশোর সন্তান ঢাকার শনির আখড়া এলাকার একটি কসমেটিকস দোকানের কর্মচারি ইউনূছ আলী শাওন(১৭)।

বুধবার ( ৩১ জুলাই) বিকালে এ প্রতিবেদক শাওনের পরিবারের অবস্থা জানতে তার গ্রামের বাড়িতে যান। গ্রামের অনেকের সাথে কথা হয়। সবার একই কথা শাওনের মত ভালো ছেলে হয়না।
নিহত শাওনের প্রতিবেশী ও এলাকার বার বার নির্বাচিত সাবেক মেম্বার এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হারুনুর রশিদ পাটওয়ারী ও সমাজ কর্মী আনোয়ার হোসেন পাটওয়ারী সহ অনেকেই কিশোর শাওনের প্রশংসা এবং বিভিন্ন স্মৃতি চারণ করে বলতে থাকেন এমন ভদ্র ছেলে আরো একটি এই গ্রামে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। ঈদে বাড়িতে বেড়াতে এলেও দোকানে আড্ডা দিতেননা শাওন। দোকানে চা খেতে এলে মুরুব্বীদের সালাম দিয়ে উঠে জায়গা করে দিতেন বলে জানিয়েছেন গ্রামের চা দোকানী শহীদুল ইসলাম।
হারুনুর রশিদ পাটওয়ারী জানান, শুধু শাওন নয় তার বাবাও কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নেই। সাদাসিদে মাটির মানুষ আবুল বাশার ও তার পরিবার।
লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড দক্ষিণ মাগুরী গ্রামের ক্বারি সাহেবের বাড়ির হত দরিদ্র বৃদ্ধ আবুল বাশারের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভের একমাত্র সন্তান মোঃ ই্উনূছ আলী শাওন। আবুল বাশারের প্রথম স্ত্রী দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মারা গেলে তিনি শাওনের মা কুলছুম বেগমকে বিয়ে করেন। কুলছুম বেগমের গর্ভে শাওনের জম্ম। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জম্ম নেওয়া বড় ছেলে একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুর করেন। পরিবার নিয়ে সে ঢাকায় থাকেন। যে বেতন পান তা দিয়ে স্ত্রী সন্তানের ভরণ পোষণ আর বাসা ভাড়া দিয়ে চলতেই কষ্ট হয় তার।
বাবা মাকে দুই পয়সা দেওয়ার সুযোগ হয়না বড় ছেলের। আরেক ছেলে মানষিক রোগী। নিয়মিত ঔষধ না খাওয়ালে তার রোগ বেড়ে যায়। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের সহায় সম্বল বলতে এক চিলতে বসত ভিটি ছাড়া আর কিছুই নেই। গ্রামের রাস্তায় সবজি লাগিয়ে ও অন্যের এক খন্ড জমি বর্গা চাষ করে যা পান তাই পরিবারের আয়। আর শাওনই এ হত দরিদ্র পরিবারের একমাত্র নগদ টাকা আয়ের উৎস ছিল।
পরিবারের অভাব অনটনের কারণে শাওনের পড়া লেখা করা সম্ভব হয়নি। গ্রামের মাদ্রাসা থেকে ৫ম শ্রেণী পাশ করার পর পরই ফুফাতো বোনের জামাইয়ের সাথে চলে যান ঢাকায়। শনির আখড়া এলাকায় সেই বোন জামাই এর কসমেটিক দোকানে সেলসম্যানের চাকুরী করতো শাওন। গত ৮ বছর ধরে শাওন ফুফাতো ভগ্নিপতি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বসিকপুর গ্রামের মোল্যা বাড়ির শাহজাহানের কসমেটিকস দোকানে চাকুরী করে আসছেন। নিজ বাসায় থাকা খাওয়া দিয়ে শাহজাহান শাওনকে মাসে ৫হাজার টাকা বেতন দিতেন।
সংসারের অভাব অনটনের কারণে সেই টাকা থেকে কখনো ৪ হাজার কখনো কখনো আবার পুরো টাকাটাই পাঠিয়ে দিতেন বাবার কাছে। সে টাকায় বাবা আবুল বাশার মানষিক প্রতিবন্ধী ছেলের ঔষধ কিনে বাকী টাকা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতেন। আর স্বপ্ন দেখতেন একদিন তার ছেলে বড় হবে তার অভাব অনটন সবই গুছবে। শাওনও বাবাকে স্বপ্ন দেখাতেন আর বলতেন বাবা চিন্তা করবেননা আমি ব্যবসা শিখে নিই। তার পর আপা ও দুলা ভাইকে বলবো আমাকে একটি দোকান কিনে দিতে। এক সময় আমাদের নিজের দোকান হলে আমাদের আর কোন অভাব থাকবেনা।
২০ জুলাই দুপুরে প্রতিদিনের মত শাওন দোকান বন্ধকরে খাবার খেতে বাসায় ফিরছিলেন। দোকানের বাইরে আসার পরপরই দুরের হেলিকপ্টার থেকে পুলিশের ছোড়া দুটি গুলি এসে লাগে শাওনের বুকেও পেটে। বুকের গুলিটি শরীর বেদ করে বেরিয়ে যায়। শাওন লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এক সময় গুলি বর্ষণ বন্ধ হলে উপস্থিত লোকজন এসে শাওনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। হাসপাতালে নেওয়ার আগে শাওন তার পকেটে থাকা কি প্যাড মোবাইলটি দেখিয়ে দিয়ে উদ্ধারকারি একজনকে বলেন আব্বু নামে আমার বাবার মোবাইল নাম্বারটি সেভ করা আছে আমার খবরটি আমার বাবাকে জানিয়ে দিন। শাওনের কথামত তিনি আবুল বাশারকে তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানান।
পুত্রের মোবাইল থেকে ফোন পেয়ে আবুল বাশারের মনে আনন্দ দেখা দিলেও খবরটি পেয়ে যেন আকাশ ভেঙ্গে তার মাথায় পড়েছে। চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। সবাই ছুটে এসে সে মোবাইল নাম্বারে ফোন করে জানতে পারেন শাওন আর এই দুনিয়াতে নেই। খান খান হয়ে যায় আবুল বাশারও তার স্ত্রী কুলছুম বেগমের লালিত সব স্বপ্ন।
গ্রামবাসী জানায়, এক সময় একটি বসত ঘরের অভাবে রোদেপুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আবুল বাশারের পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করতো। পরবর্তীতে গ্রামের লিটন সহ কয়েকজন সহযোগীতা করে আবুল বাশারকে টিনের একটি বসত ঘর তৈরী করেন।
বাড়ির সামনেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করাহয়েছে শহীদ কিশোর শাওনকে। ছেলের কবর দেখাতে নিয়ে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আবুল বাশার। ঘরে গিয়ে দেখাযায় নামাজের বিছানায় বসে পুত্রের জন্য দোয়া করছেন মা কুলছুম বেগম।
একমাত্র সন্তান ও পুত্র শাওন নিহত হওয়ার পর থেকেই নির্বাক হয়ে গেছেন কুলছুম বেগম। কারো সাথেই তেমন কথা বার্তা বলছেননা তিনি। খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে দিয়ে বেশীর ভাগ সময়ই তিনি ছেলের জন্য দোয়া কালাম পড়ে সময় পার করছেন, আবার কখনো গুনগুন করে কাঁদছেন এই হতভাগী মা।
তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা কারো নেই। আর কি বলেই বা তাকে শান্তনা দিবেন তাকে? সে ভাষাও গ্রামবাসী ও আত্নীয় স্বজন কারোরই জানানেই।
কিশোর শাওন ২০জুলাই দুপুরে নিহত হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাওনের ময়না তদন্ত করে লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয় পরদিন ২১ জুলাই রাতে। ২২ জুলাই সকাল ১০টায় নিজ বাড়িতে গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে দাফন হয় পারিবারিক কবরস্থানে।
সাবেক ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা হারুনুর রশিদ পাটওয়ারী, আনোয়ার হোসেন পাটওয়ারী, সহিদুল ইসলাম সহ গ্রামবাসীর দাবী শাওনের খুনির যেন বিচার হয়। পাশাপাশি এই পরিবারকে যেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী খেয়ে পরে বাঁচার মত কোন একটি ব্যবস্থা করে দেন।
লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড: নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি জানান, ঢাকায় কোটা বিরোধী আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে লক্ষ্মীপুরের শাওনসহ ৩ জন মারা যাওয়া খবর পেয়েছি।
তাদের তালিকা সংগ্রহ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাছে প্রেরণ করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে নিহতের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য কাজ করছি।

আরও পড়ুন