• ঢাকা
  • বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২৮ জুলাই, ২০২৪
আপডেট : ২৮ জুলাই, ২০২৪



মেঘনা নদীর টানা অস্বাভাবিক জোয়ারে ভাসছে রামগতির ২০ গ্রাম

গ্রামীণ কণ্ঠ

রামগতি থেকে সারোয়ার মিরণ : মেঘনা নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ার বয়ে যাওয়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে বিস্তীর্ণ জনপদসহ উপকূল ভাসছে জোয়ারের পানিতে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির কবলে পড়ছেন সাধারন মানুষ। নষ্ট হচ্ছে রাস্তাঘাট, ক্ষতি কবলে আমন চাষীরা। অন্য যে কোন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্তমানে ৫থেকে ৭ফুট বেশি উচ্চতায় জোয়ার প্রবাহিত হওয়ায় প্লবিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা।

উপজেলার চরগাজী, বড়খেরী, চররমিজ, রঘুনাথপুর, চরগোসাই, বিবিরহাট, চরআলগী চরমেহার, চরনেয়ামত, মুন্সিরহাট, সেবাগ্রাম, বাংলাবাজার, আসলপাড়া, চরআলেকজান্ডার এবং চর আবদুল্যাহসহ ২০টি গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হানা দিয়েছে পানি। অনেকেই বসতভিটায় পানি উঠে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। বিশুদ্ধ পানির অভাব, খাবারের অভাবসহ বহুমুখী সমস্যায় পুরো উপকূল জুড়ে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়।

এলাকাবাসীরা জানান, বেড়ীবাঁধ না থাকায় রামগতি-কমলনগরের ৩১কিলোমিটার উপকূলের পুরোটাই হুমকির মুখে। প্রতিবছর অমবস্যা ও পুর্নিমাসহ বর্ষা মৌসুমে প্রায়শই এসব এলাকায় হানা দেয় অস্বাভাবিক জোয়ার। মাছের ঘের, পুকুর, প্রজেক্ট, কৃষিজমি, বীজতলা, রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। প্রতিদিন দু বেলা জোয়ারে দিশেহারা কৃষক ও মৎস্য চাষীরা।

তাদের দাবি মেঘনা তীর সংরক্ষন প্রকল্পের আওতায় ৩হাজার ১শ কোটি টাকা বরাদ্ধ পাওয়া ৩১কিলোমিটার বেড়ীবাঁধটি দ্রুত নির্মান না হওয়ায় প্রতিনিয়তই জোয়ারের পানিতে ভাসতে হচ্ছে।

সরেজমিনে চরগোসাই এবং চরআলেকজান্ডার ইউনিয়নের একাধিক এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে এসব এলাকার চলাচলের কাঁচা-পাকা গ্রামীণ সড়কগুলো জোয়ারের আঘাতে ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তেমনই একটি সড়ক জনতা বাজার-মুন্সিরহাট সড়ক। তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ রাস্তাটির বেশিরভাগ অংশই ভেঙে পড়েছে। দুটি কালভার্ট ধেবে গেছে। এর ফলে এসব এলাকার অন্তত বিশ হাজার মানুষ মানবেতন জীবন যাপন করছেন। বসত ঘরে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় অনেক পরিবারকেই দেখা গেছে পুরাতন বেড়ীবাঁধের ধারে আশ্রয় নিতে। তাবু টেনে রান্না-বান্নাসহ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন তারা।

উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা যায়, উপজেলায় প্রায় ২০হেক্টর জমির বীজতলা জোয়ারে আক্রান্ত হয়েছে। চলমান মৌসুমে আমন ধান চাষের প্রস্তুতকৃত জমি এবং রোপন অপেক্ষ্যমান বীজতলাগুলোতে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে জোয়ারের লোনা পানিতে তলিয়ে থাকায় ইতিমধ্যে চাষযোগ্য জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমন বীজতলা গুলোও তলিয়ে থাকছে পানিতে। উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে কৃষকরা আমন ধান রোপার জন্য বীজতলা ও জমি তৈরি করছে। এ অবস্থায় জোয়ারের পানিতে বীজতলাসহ কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে।

পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোয়ার হানা দেয়ায় শ্রেনিকক্ষ, খেলার মাঠ এবং শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের পথঘাট মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে রামগতি আছিয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রঘুনাথপুর পল্লীমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়, রামগতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঘনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চররমিজ দক্ষিন পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বালুরচর ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসাসহ ত্রিশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে জোয়ারের পানি।

চরআলগী এলাকার কৃষক ছৈয়দ আলী এবং চররমিজ ইউনিয়নের শাহাবউদ্দিন জানান, অন্যান্যবারের তুলনায় জোয়ারের পরিমান এবার অনেক বেশি। এভাবে আর কয়েকদিন থাকলে বীজতলা নিয়ে বিপদে পড়ে যাব। চরগোসাই এলাকার শাহাদাত ও মনোয়ার হোসেন এবং বড়খেরীর সামছুল ইসলাম ও বালুরচর মুন্সিরহাট এলাকার  মো: আলী জানান, অন্য সময়ের তুলনায় এবারের জোয়ার অনেক বেশি হচ্ছে। পানিবন্দি পরিবার পরিজন নিয়ে কোনমতে সময় পার করছি। নদীর বাঁধটা হলে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

বড়খেরী ইউনিয়ন পরিষদসূত্রে জানা গেছে, এ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের ৫টি ওয়ার্ড মেঘনা উপকূলবর্তী হওয়ায় সবগুলোই জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ওয়ার্ডে বসবাসকারী বেশ কয়েকটি পবিবারের ঘরের ভিটি জোয়ারে ভেস্তে গেছে। রঘুনাথপুর এলাকায় একটি জামে মসজিদ প্রায় পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ জোয়ারে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এ অস্বাভাবিক জোয়ার হানা দিয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান হাসান মাকসুদ মিজান জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালে এসব এলাকার মানুষগুলো একেবারে সর্বশান্ত হয়ে গেছে। অনেকে ধারদেনা করে বাড়ি ঘর ঠিক করলেও এখন আবার জোয়ারে হানা দিয়েছে। তিনি জানান, সরকার থেকে ইতিমধ্যে ২৫টন চাল বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা উপজেলায় পাঠানো হয়েছে।

চর আলেকজান্ডার ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সরকারি বরাদ্ধ পাওয়া ৩টন চাল বিতরন করা হয়েছে। মাসখানেক আগে সাড়ে ৩লক্ষ টাকা ব্যয়ে সংষ্কার করা জনতা বাজার- মুন্সিরহাট সড়কটি প্রায় পুরোটাই আবার জোয়ারে ভেস্তে গেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারসহ অন্য যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপজেলার মধ্যে এ ইউনিয়নটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে বেশ কয়েকজন ইউপি সদস্য নিশ্চিত করেছেন। চেয়ারম্যান শামীম আব্বাছ সুমন জানান, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো প্রতিবারই মেরামত করা হয়, অতিরিক্ত জোয়ারে প্রতিবারই ভেঙে পড়ে। বেশ কয়েকটি স্থানে সাঁকো তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ তারেক জানান, জোয়ারের পানি সাথে সাথে নেমে যাওয়ায় বীজতলা তেমন ক্ষতির আংশকা নেই। তবে জমে থাকা পানিতে কিছুটা ক্ষতির শংকা থাকলেও আমাদের হাতে পর্যাপ্ত আমন চারা (বীজ) রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহি অফিসার সৈয়দ আমজাদ হোসেন জানান, জোয়ারের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু এলাকায় বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।

আরও পড়ুন