নিজস্ব প্রতিবেদক: লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরে মেঘনা নদীর তীররক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশা বাড়ছে। ঠিকসময়ে একযোগে কাজ শুরু না করা, নির্মাণকাজে অনিয়ম-ধীরগতি ও উদ্বোধনের পর কাজ বন্ধ রাখায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে টেকসই বাঁধের সুফল বহুদূর বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এদিকে বর্ষা এবং শুষ্ক মৌসুমে নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, ফসলি জমি, রাস্তাঘাটসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অবকাঠামো। চলতি বর্ষায় নদীভাঙন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে। প্রায় তিন যুগ ধরে চলছে এই ভাঙন।
কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চ সূত্রে জানা যায়, নদীর ভাঙনে ৩১টি বড় হাট-বাজার, ৩৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩০টি সাইক্লোন শেল্টার, ৫২টি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার, প্রায় ৪০০ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক, ৩৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। অব্যাহত ভাঙনে প্রায় ৫০ হাজার একর ফসলি জমি ও ৪৫ হাজার ঘরবাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাপনাও বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, বাঁধের দাবিতে কয়েক বছর ধরে রামগতি ও কমলনগরের বাসিন্দারা আন্দোলন করছেন। বাঁধ না থাকায় পুরো মেঘনা উপকূলটিই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। জোয়ার আসলেই প্লবিত হয় বিস্তির্ণ জনপদ। এ দুটি উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার এলাকা মেঘনা নদীর উপকূল রয়েছে। ৩ যুগের ভাঙনে কয়েক কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বর্তমানে এ জনপদের ৩২ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এজন্য ভাঙনরোধে সরকার রামগতির বড়খেরী থেকে কমলনগরের কাদির পণ্ডিতেরহাট পর্যন্ত টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। গেলো বছরের ৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হলেও ঠিকাদারদের গাফিলতি ও কাজের ধীরগতির কারণে দৃশ্যমান অগ্রগতি শূন্যতেই ঠেকে আছে। কারণ কমলনগরের পাটওয়ারীরহাট রাস্তার মাথার দক্ষিণাংশের জিওব্যাগ ডাম্পিং ও মাটি ভরাট করে নির্মিত বাঁধের ওপর দিয়েই জোয়ারের পানি আসা-যাওয়া করছে। এতে টেকসই বাঁধ নিয়ে শঙ্কিত উপকূলবাসী।
সর্বশেষ গত বছরের ১০ নভেম্বর পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম বাঁধনির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শনে কমলনগরের চরফলকন এলাকায় আসেন। তখন বালু সংকটে কাজ বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চাঁদপুরে বালু উত্তোলন না হওয়ায় মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে তা পরীক্ষা করা হবে। এ বালু যদি বাঁধ নির্মাণের উপযোগী হয় তাহলে তা ব্যবহার করা হবে। তিনি একই বছরের ৯ জানুয়ারি উপজেলার সাহেবেরহাট ইউনিয়নে এসে বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন।
চলমান প্রকল্পের আগে রামগতি ও কমলনগরের সাড়ে ৩ কিলোমিটার নদীতীর রক্ষা বাঁধের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এরমধ্যে রামগতি বাজার ও আলেকজান্ডারের সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকায় সেনাবাহিনী বাঁধ নির্মাণ করায় উপজেলা পরিষদ ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিস্তির্ণজনপদ ভাঙন থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু ওই একই প্রকল্পে কমলনগরের মাতাব্বরহাট এলাকায় এক কিলোমিটার নদীতীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ওই বাঁধ পরপর ১০ বার ধসে পড়তে দেখা গেছে।
লক্ষ্মীপুর পাউবো কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ১ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে লক্ষ্মীপুরের ৩৩ দশমিক ২৬ কিলোমিটার নদী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প পাস হয়। এর ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে একই বছরের আগস্টে ৯৯টি প্যাকেজ করে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এর আওতায় এ পর্যন্ত ৪৩টি ভাগে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার এলাকার জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কমলনগরে ৮ ও রামগতিতে সাড়ে ৫ কিলোমিটার। কমলনগরে ২৬ এবং রামগতিতে ১৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। আরও ৩৪টির কার্যাদেশ অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক দুই ইউপি চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে, উদ্বোধনের পর ১৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাঁধের কাজ শুরু করে। ৩ মাসের মাথায় তারা বালু সংকটসহ ঠুনকো অজুহাতে কাজ বন্ধ রাখে। সম্প্রতি চাপের মুখে ঠিকাদাররা কাজ শুরু করলেও আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। কাজের মান নিয়েও আপত্তি রয়েছে।
সাংবাদিক সাজ্জাদুর রহমান জানান, বাঁধ নির্মাণ কাজ যথাসময়ে একযোগে শুরু হয়নি। এরমধ্যে নানান অজুহাতে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এখনো অনেক স্থানে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়নি। এ জনপদ রক্ষায় একযোগে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
চরলরেন্স ইউনিয়নের নবীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সফিক মাঝি বলেন, পুরাতন সাহেবেরহাট থেকে শুরু করে হাজিগঞ্জ, নবীগঞ্জ ১০ বছর ধরে ভাঙছে। সাহেবের হাট থেকেই কাজ শুরু হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে, ভাঙন ঠেকাতে তা উপযুক্ত নয়। জোয়ার এলে পানির নিচেই থাকে ডাম্পিংকৃত জিও ব্যাগ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শুধু সময় অপচয় করছে। স্থানীয়রা এনিয়ে নানান অভিযোগ করলেও শুনছে না পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন। তাদের কর্মকর্তারা এসে শুধু দেখে যায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রাশেদ বলেন, হাজিগঞ্জ থেকে এক কিলোমিটার দূরে আমার তেলের দোকান ছিল। এ এক কিলোমিটার এলাকা নদী গিলে নিয়েছে। এতে ১৫ বার আমার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান সরাতে হয়েছে। এখন আবারো ভাঙন বাড়ছে।
কমলনগরে ৪টি প্যাকেজের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সালেহ আহম্মদ। প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান সাড়ে ১২ মিটারের কাজ পেয়েছে। এতে ১১৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এরইমধ্যে জিওব্যাগ ডাম্পিং ও মাটি ভরাটের কাজ শেষে হয়েছে। বর্ষার কারণে ব্লক নির্মাণ কাজে বেগ পেতে হচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ৩০০ মিটার কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পায় মেসার্স এম আর কনস্ট্রাকশন ও কে কে এন্টারপ্রাইজ। চরলরেন্স গ্রামে নদীর পাড়ে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করছে তারা।
জানতে চাইলে ঠিকাদারের সহযোগী কবির হোসেন জানান, তারা কার্যাদেশ দেরিতে পেয়েছেন। এতে কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করা হবে। বর্ষার শেষে মাটি ফেলে ও ব্লক স্থাপন করে কাজ সম্পন্ন করা হবে। কাজে কোনো অনিয়ম নেই।
কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চের আহ্বায়ক আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, বাঁধের কাজ নিয়ে ৭ লাখ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের পথে। অধিকাংশ ঠিকাদার কাজ না করে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এতে পাউবোর তদারকি না থাকায় যা ইচ্ছা তাই কাজ করা হচ্ছে। আমরা অব্যাহত আন্দোলন করেও কোনো সুফল পাচ্ছি না।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, বাঁধনির্মাণ প্রকল্পে ১৩ কিলোমিটার এলাকায় ৪৩ ভাগে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। নদী উত্তাল থাকায় কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আগামী অর্থবছরের মধ্যে ব্লক নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করা হবে। বর্ষায় যেখানে ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে আপদকালীন জরুরি মেরামতের কাজ করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :