সাফল্যের শেকড়ে গাঁথা জান্নাতুলের প্রাণ। স্বপ্ন দেখতে জানেন জান্নাতুল, জানেন স্বপ্নকে পরিচর্যা করতে, তাই স্বপ্নও সাফল্যের মুঠোবন্দি হয়ে ধরা দেয় তারই কাছে। বলছি, জান্নাতুল মাওয়া অরিনের কথা। কুষ্টিয়ার মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া অরিন ছোটো থেকেই ছিলেন দুরন্ত, একইভাবে তার স্বপ্নের গতিও সবসময় ছিল দুর্নিবার। তাই জীবন যাপনের পথে নানা অর্জন ও সাফল্যের ফুলে ভরে উঠেছে তার প্রাপ্তির ঝুড়িটি।
জান্নাতুল মাওয়া অরিন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য এবার পিএইচডি তার লক্ষ্য। স্বপ্নের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে জান্নাতুল অগ্রগামী, পড়াশোনা চাকরির সাথে সমান তালেই চলছে তার উদ্যোক্তা কার্যক্রম। সাংসারিক, ব্যক্তিগত, কর্মজীবন সবদিকই দক্ষ হস্তে সামলে চলেছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেয়েছেন ডিনস ম্যারিট অ্যাওয়ার্ড ২০১৩, স্নাতক সম্পন্ন করার পর। আবার ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেও।ডিন্স ম্যারিট অ্যাওয়ার্ড পান। পেয়েছেন ইবিএল-ডিইউএএ, টোকিও মিতসুবিসি ইউএফজি স্কলারশিপ।
সাফল্যের গল্পটা যত সহজে বলছি, আসলে সাফল্য অর্জনের পথ কি এতটাই মসৃণ ছিল? আসলে, সাফল্যের কোনো সহজ পথ নেই। জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর চেষ্টার পাশাপাশি থাকতে হয় অসীম সাহস, অক্লান্ত অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রম। কারণ সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে হলে বিভিন্ন বাঁধা জয় করেই সামনে এগিয়ে যেতে হয়।
শেখ মাজহারুল ইসলাম ও নিলুফা ইয়াসমিন দম্পতির সন্তান জান্নাতুল মাওয়া অরিন। চার ভাইবোনের মধ্যে জান্নাতুল মাওয়া অরিন সবার ছোটো, অনেক স্নেহ আদর এবং ভালোবাসায় বড়ো হয়েছেন। এদিকে, তার বাবা দশ ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন সবার বড়ো, অর্থাৎ পরিবারের বড়ো সন্তান। জান্নাতুলের দাদা-দাদি অনেক ছোটোবেলায় পরলোকগমন করেন, ফলে জান্নাতুলের বাবাকে অনেক অল্প বয়সেই জীবন যুদ্ধে নামতে হয়। শেখ মাজহারুল ইসলাম একটি প্রাইভেট অর্গানাইজেশনে চাকরি করতেন, অনেক পরিশ্রম আর সংগ্রাম করেছেন ভাইবোন ও একইসাথে নিজের সন্তানদের মানুষ করার জন্য । অরিনের বাবা এবং মা দুজনই একটা যৌথ পরিবার এমন করে আগলে রেখেছেন যা অরিনকে শিখিয়েছে প্রবলভাবে বাঁচতে, সকলের জন্য আত্মনিবেদিত থাকতে, দেখিয়েছে জীবনের পরম সৌন্দর্য।
অরিনের সবসময় ইচ্ছা ছিল ভালো কিছু করতেই হবে আর এই বিষয়টা তার পরিবার থেকে ছোটবেলায় তার মধ্যে সব সময় অনুপ্রেরণা দিত। ছোটবেলায় তার ছোট চাচা স্ট্রোক করাতে মারা যায় এবং ছোট চাচা ছিল রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট হওয়া অত্যন্ত মেধাবী একজন স্টুডেন্ট। কিন্তু অরিনের চাচা মারা যাওয়ার কারণে তার পুরো পরিবারের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।
পরিবারের সবাই স্বপ্ন দেখত, জান্নাতুল মাওয়া অরিন একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে সেই স্বপ্নটা পূরণ করবে।
একদম মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় পড়তে এসে জান্নাতুল মাওয়া অরিন কিছুটা খাপছাড়া অনুভূতিতে পড়লেও পরিবারের উৎসাহ ও নিজ লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতায় সব সামলে ওঠেন। কুষ্টিয়ার পাইকপাড়া জনকল্যাণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করার পর, ভর্তি হন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। সেখানেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন, পান জিপিএ ৫। তারপর চলে আসেন ঢাকায়। ধ্যানজ্ঞান দিয়ে পড়াশোনা করেন।
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পড়ার প্রতি আগ্রহ কেন হল এবং এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে পরিবার থেকে না শুনেছেন কি না, জানতে চাইলে জান্নাতুল বলেন, পরিবার আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়েছে। যৌথ পরিবারে ছিলাম এবং ছোটো ছিলাম বলে আমার সব চাওয়া সবসময়ই পূরণ করার চেষ্টা করত বাড়ির সবাই। আমিও সবার প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছি সবসময়ই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পাওয়ার আগে কিছুদিন মেসে ছিলাম। যেখানেই ছিলাম যেভাবে ছিলাম পড়ালেখা করেছি, নিজের করণীয়টুকু সঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি, সফল হতে গেলে লক্ষ্য পূরণ করতে চাইলে এটাই বেশি জরুরি।
কর্মজীবনের শুরুতে ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অফ আইটি (ডিআইআইটি) তে প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন ২০১৭ সালে। আর বর্তমানে তো নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পিএইচডি করছেন ঐ বিভাগের শিক্ষক ড সউদ আহমেদ , সহযোগী অধ্যাপক (পিএইচডি ইউ কে/ UK)। তাকে প্রশ্ন করা হয় উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে কেন চেষ্টা করলেন না? তার উত্তর ছিল, পরিবার সংসার ছোট একটা বাচ্চা সব মিলিয়ে ডিসিশন নিয়েছি বাংলাদেশে করবো পিএইচডি আর সুপারভাইজারও অনেক অসাধারণভাবে কাজ শেখাচ্ছেন। নিজের উপর তার সম্পূর্ণ আস্থা, তাই তিনি স্বপ্ন দেখেন যে তার পিএইচডি শেষে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, ট্যুরিজমেও তিনি কন্ট্রিবিউশন রাখতে পারবেন।
কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিজীবনে ব্যালেন্স করেন কীভাবে জানতে চাইলে জান্নাতুল বলেন, আসলে পারিবারিক এনভায়রনমেন্টটা খুব জরুরি। ব্যক্তির নিজেকে যেমন চেষ্টা করতে হবে তেমনি পরিবার থেকে উৎসাহ ও সহযোগিতা জরুরি। পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে, আর তাতেই ব্যক্তি মানুষ সফল হওয়ার মূলমন্ত্র নিহিত। আমি আমার আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়েই পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব করছি। ছোটোবেলায় পরিবারের সাপোর্ট যেভাবে পেয়েছি এখনও পরিবার, বিশেষ করে আমার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি আমাকে সেভাবে সাপোর্ট দেয়। একটা মেয়ের জন্য এটা বেশি জরুরি।
জান্নাতুল আরো বলেন, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে আগের তুলনায় যথেষ্ট এগিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের ক্ষমতায়িত নারীদের একজন, কিন্তু এখনও এই দেশে উচ্চ শিক্ষা নারীর জন্য ‘বাধা’। এই বাধা পেরিয়ে সফল হতে একটি মেয়ে যেমন দায়বদ্ধ, পরিবার ও সমাজেরও তাকে সহযোগিতা করতে হবে। আমি সবসময়ই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কথা খুব মেনে চলি, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’।
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি কতটা গুরুত্ববহ জানতে চাইলে জান্নাতুল মাওয়া অরিন বলেন, বাংলাদেশ পর্যটনে খুব সম্ভাবনাময় একটি দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত বছরগুলোতে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে, সবচেয়ে বড় যেই অবদানটি তা হলো পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু হওয়ার পর যাত্রাপথ এত সংক্ষিপ্ত হয়েছে যে পথে কত দীর্ঘ সময় লাগবে সেই দুশ্চিন্তায় পর্যটক থাকছে না। এছাড়া সাবরাং, ককক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিনে ট্যুরিজমের নানা সুযোগ সুবিধা পর্যটনে ভ্রমণে উৎসাহিত করছে। মানুষ এখন সুযোগ পেলেই ঘুরতে যায়। এটা দেশের পর্যটনকে যেমন সমৃদ্ধ করছে তেমনি মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থাও করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিতে হয় অবশ্যই।
পর্যটন স্পট রক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা জানতে চাইলে, তিনি একবাক্যে জানান পর্যটককে তো সচেতন হতেই হবে। এ ব্যাপারে, পর্যটন স্পটগুলোতে টুরিস্ট পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে। হয়তো আগামী দশ বছর পর দেশের পর্যটন শিল্প আমূল বদলে যাবে।
জান্নাতুল মাওয়া অরিন ড্যাফোডিল ইন্সটিটিউট অফ আইটি এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের ফাউন্ডিং মেম্বার ছিলেন। প্রত্যাশা করেন সারাদেশেই, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট- এই বিষয়টির গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করবে। এরকম উদ্যোগী যত কাজ সব কাজেই মনপ্রাণ দিয়ে লেগে থাকতেন চান জান্নাতুল মাওয়া অরিন। সারাবিশ্বের পর্যটনেই পর্যটকরা বাংলাদেশকে চিনুক, জানুক, দেখুক, ভ্রমণ করুক এমন স্বপ্ন তার চোখে। এই স্বপ্নের চোখেই দেখতে চান বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।
আপনার মতামত লিখুন :