নিজস্ব সংবাদদাতা: লক্ষ্মীপুরে একটি আলিম মাদ্রাসায় হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে অস্পষ্ট হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে ভালো পরীক্ষা দিতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন পরীক্ষার্থীরা। ১ থেকে দেড় হাজার টাকা ফি নিয়ে ডিজিটাল যুগে হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ায় ক্ষিপ্ত পরীক্ষার্থীর অভিভাবকরাও।
সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের গন্ধব্যপুর ইসলামিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় প্রথম থেকে নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা ও দশম শ্রেণির পাক নির্বাচনী পরীক্ষায় এ ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনাকে তুচ্ছ করে দেখছেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ওমর ফারুক। তার দাবি, ‘শিক্ষকদের প্রতিভা বিকশিতের লক্ষ্যে হাতে লেখা প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়েছে’।
একই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত ফি না দিতে পারায় তাদেরকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। হতদরিদ্র শিক্ষার্থীরা ১৫০০ টাকা ফি যোগাড় করতে পারেনি। এরমধ্যে কেউ কেউ ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিবে বললেও তাদেরকে পরীক্ষায় বসতে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। অনুষ্ঠিতব্য সকল পরীক্ষায় হাতে লেখা প্রশ্ন দিয়ে দিতে হয়েছে। লেখাগুলো অস্পষ্ট। এতে উত্তরপত্রে উত্তর লিখতে তাদের সমস্যা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলেও প্রশ্ন বুঝতে না পারায় সবগুলো উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষকরা জানিয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে প্রশ্ন বুঝে নিতে। একটি প্রশ্ন বুঝে নিতেও সময়ের প্রয়োজন হয়। এতে বাড়তি সময় অপচয় করে পরীক্ষায় সঠিকভাবে উত্তর লেখা সম্ভব নয়। এবারের পরীক্ষায় পাশ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে যেতে পারে। ডিজিটাল যুগে এসে হাতে লেখা প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার ঘটনা তাদের কাছে বিরল মনে হয়েছে।
কয়েকজন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, গন্ধব্যপুর গ্রামের এখনো অনেক মানুষ অস্বচ্ছল। যারা একদিন কাজে না গেলে ঘরে খাবার জোটে না। এসব পরিবারের শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসাটিতে পড়ালেখা করে। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ ওমর ফারুক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। পরীক্ষার ফি’র জন্য অতিরিক্ত টাকা ধার্য করেছে। ওই টাকা দিতে না পারায় কয়েকজন দরিদ্র পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় বসতে পারেনি। পরীক্ষার ফি’র জন্য অতিরিক্ত টাকা নিয়েও কম্পিউটারাইজড প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়নি। তাদের হাতেলেখা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এসব প্রশ্নপত্র অস্পষ্ট ছিল। খাতায় সবগুলো প্রশ্নের উত্তর লিখতে না পেরে অনেক পরীক্ষার্থী বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটিও করেছে। এ বিষয়ে অভিভাবককরা শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইলে, তারা (শিক্ষক) এলোমেলোভাবে কথা বলেন। যা গ্রহণযোগ্য নয়। মূলত মাদরাসার অধ্যক্ষ একজন দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক।
চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের অভিভাবক মো. রফিক ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র মাহবুবুর রহমানের বাবা আবদুল কুদ্দুস জানায়, প্রতিষ্ঠানের ধার্যকৃত ফি দেওয়ার পর তাদের ছেলেদের পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছিল হাতেলেখা ও অস্পষ্ট। প্রশ্ন বুঝতে না পেরে তারা ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারেনি। মাদরাসায় কম্পিউটার ও অপারেটরও আছে। এরপরও হাতেলেখা প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া দুর্নীতির আবাস। ইংরেজী প্রশ্ন হাতে লেখা হওয়ায় শিশু মাহবুবুর রহমান কিছুই বোঝেনি। প্রশ্নটি সে বাড়িতে এনেছে। ওই প্রশ্ন শুধু মাহবুব না, বড়রাও বুঝতে পারবে না।
শিশু শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি স্যারদের হাতের লেখা প্রশ্ন বুঝিনি। তাই কিছু লিখতে পারিনি।
দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাসলিমা আক্তার বলেন, আমাদের পাক নির্বাচনী পরীক্ষার ছয় বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সবগুলো প্রশ্নপত্র হাতে লেখা ছিল। আমার সহজে বুঝতে পারিনি। শিক্ষকরা বলছে আমরা না বুঝলে বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষা হয়। এ সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশ্ন বুঝে নিতেই অর্ধেক সময় অপচয় হয়। তাই সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারিনি।
মাদরাসার অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মিশু আক্তার বলেন, আমাদের ১৫৩০ টাকা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। আমার দিনমজুর বাবার এতো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তবে ৫০০ টাকা দিতে চাইলে শিক্ষকরা তা গ্রহণ করেনি। তারা জানিয়েছে, ১৫০০ টাকার নিচে টাকা না দিলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না। টাকার অভাবে আমি পরীক্ষায় বসতে পারিনি।
অষ্টম শ্রেণীর আরও এক ছাত্রী জাহেদা আক্তার বলেন, আমার বাবা সৌদি আরব থাকেন। দীর্ঘদিন তার কাজ নেই। কর্মহীন হয়ে বসে আছেন। এখন খুব কষ্টে তাদের সংসার চলে। ১৫৩০ টাকা দিয়ে পরীক্ষা বসা সম্ভব ছিল না। ৫০০ টাকা দিতে চাইলেও শিক্ষকরা তা নেবেনা বলে আমাকে পরীক্ষায় বসতে দেয়নি। তারা জানিয়েছে টাকা দিতে পারেনি বলে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসতে দেয়নি শিক্ষকরা।
পরীক্ষায় বসতে না পারা মিশু আক্তারের চাচা মো. রফিক বলেন, টাকা জন্য শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারছে না। এটা কেমন নিয়ম? আমাদের আর্থিক সমস্যা থাকলে কি আমরা সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারবো না? আমরা মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
মাদরাসার অধ্যক্ষ ওমর ফারুক বলেন, হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে শিক্ষকদের প্রতিভা বিকশিত হয়। শিক্ষার্থীরা ওই প্রশ্ন বুঝতে সমস্যা হলে, শিক্ষকদের কাছ থেকে বুঝে নেবে। পরীক্ষা ফি’র বেশি হওয়ায় কয়েকজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারছে না তা আমার জানা নেই। সকল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই শিক্ষকদেরকে বলা ছিল। পরীক্ষা দিতে না পারার ঘটনায় কেউ আমাকে কিছু জানায়নি।
মাদরাসার সভাপতি সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রহমত উল্যা বিপ্লব সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি আমার জানা ছিল না। কেউ আমাকে কিছুই জানায়নি। অধ্যক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হবে।
লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) মেহের নিগার সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :