• ঢাকা
  • বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১৫ জুন, ২০২৪
আপডেট : ১৫ জুন, ২০২৪



রামগতিতে রাতের আঁধারে চুরি হচ্ছে নদী বাঁধের পাথর

গ্রামীণ কণ্ঠ

সারোয়ার হোসেন, রামগতি: রাত ঘনিয়ে আসলেই ট্রাকে-ট্রাকে চুরি করে বিক্রি হচ্ছে মেঘনা তীর সংরক্ষন বাঁধের পাথর ও সিলেকশন বালু। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন ও এবং স্থানীয় কয়েজজনের যোগযাজশে তিন মাস ধরে এমন ঘটনা চললেও অবশেষে স্থানীয় জনতার হাতে আটক হয়ে তিনটি পাথর ভর্তি ট্রাক্টরট্রলি। এ সময় পালিয়ে গেছে আরো ৬টি ট্রাক্টরট্রলি এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট লোকজন। নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধের ব্লক তৈরির জন্য আনা এসব পাথর ও বালি বিক্রির ঘটনাটি ঘটেছে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার ৪নং চরআলেকজান্ডার ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সেবাগ্রামের মেঘনা তীরে। অবৈধভাবে এ পাথর ও বালি বিক্রির সাথে জড়িত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্স এ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক, স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী মাঈন উদ্দীন ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন রায়হানসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী।
বুধবার রাত ৯টার সময় স্থানীয় জনতা তিনটি গাড়ি আটক করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক এবং গাড়িচালকদের জিজ্ঞাসা করলে তারা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন। এসময় কৌশলে কেটে পড়েন পানি সাইট দেখভাল করা মাইন উদ্দিন এবং গাড়ি চালকরা। পরে এলাকাবাসী স্থানীয় সংসদ সদস্য, রামগতি থানা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জাতীয় জরুরী সেবা নম্বর ৯৯৯কে কল করে ঘটনাটি অবহিত করা হয়। রাত দশটার দিকে রামগতি থানা পুলিশের একটি টিম পাথরভর্তি তিনটি ট্রাক জব্দ করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কাজ বন্ধ থাকলেও ৯টি ট্রাক্টরট্রলিতে করে পাথর ও সিলেকশন বালু অন্যত্র নেয়ার ফলে স্থানীয়দের মাঝে সন্দেহের উদ্রেক ঘটে। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এসব পাথর ও বালি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে নদী বাঁধের কাজে আনা এসব পাথর ট্রাক্টরট্রলিতে করে নিয়ে জমানো হচ্ছে রামগতি পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড শিক্ষাগ্রামে উপজেলার পরিষদের পেছনের খোলা মাঠে। পরে ওখান থেকেই এক দু ট্রাক করে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী মো: আরমান হোসেন, মঞ্জুর আলম, সালেহ উদ্দিন, মো: মাসুদসহ বেশ কয়েকজন জানান, ২০২১ সালে পাটোয়ারী বাড়ি সংলগ্ন মেঘনা তীর সংরক্ষণ বাঁধের কাজ শুরু হলেও অদ্যবধি এর কাজ শেষ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ^াস কন্সট্রাকশন। অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে নির্মান সামগ্রী। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় দুই শতাধিক সিমেন্ট ব্যাগ। প্রথম দিকে ডাম্পিং করা জিও ব্যাগগুলোও ভেস্তে গেছে প্রবল টেউয়ে। তারা আরো জানান, নদীবাঁধের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম কাজ শুরু হয়ে এ পয়েন্টের ৭শ মিটার। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকলেও গতো কয়েক মাস ধরে ট্রাক্টরট্রলিতে করে মালামাল এদিক-সেদিক নেয়া হচ্ছে। আজকে সন্দেহ হওয়ায় গাড়িগুলো আটক করতে পারলেও পালিয়ে গেছে কোম্পানির লোক এবং গাড়ি চালকরা। অন্যান্য পয়েন্টের কাজ অনেক পরে শুরু হয়েও শেষ হওয়ার পথে, কিন্তু এ পয়েন্টের কাজের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।
লক্ষ¥ীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানাযায়, মেঘনার অব্যহত ভাঙন থেকে কমলনগর ও রামগতি উপজেলাকে রক্ষায় ২০২১ সালের ১ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৩ হাজার একশ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ওই বছরের আগস্ট মাস থেকে কয়েকটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতে ৯৯টি লটে কাজ পায় ঠিকাদাররা। যার মধ্যে মধ্যে ৪৩ লটে প্রায় ১৪কিলোমিটার বাঁধ নিমার্ণের কার্যাদেশ দেওয়া হলে ২০২২ সালে ৪১টি লটের কাজ শুরু হয়। প্রতি লটে ৩০০ থেকে ৩৩০ মিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য এখন জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ চলছে। বাকি লটের কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বালু ব্যাবসায়ী মাঈন উদ্দীন জানান, থানায় আটক তিনটি পাথরসহ ট্রাক্টর টলি তার। তিনি এসব ট্রাক্টর টলি ভাড়া দিয়েছেন। অন্যদিকে এসব পাথর এবং সিলেকশন বালি রামগতি পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডে জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশলের আওয়তায় ড্রেন নির্মানে ব্যবহার করা হচ্ছে। ড্রেন নির্মানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটি ভূইয়া ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মাইন উদ্দিন জানান, এসব পাথর তারা রামগতি পৌরসভার উপসহকারী প্রকৌশলীর রিফাত জাহান ভূঁইয়ার মাধ্যমে প্রতি ফুট পাথর ১৮৫ টাকা করে ক্রয় করেছেন। এ পাথরগুলো নদী তীর সংরক্ষন বাঁধের কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্স এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির। প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হকের যোগসাজশে চক্রটি পাথরগুলো কম দামে অন্যত্র বিক্রি করেন। দু’পক্ষেরই মধস্থতাকারি ছিলেন ট্রাক্টর মালিক ও বালু ব্যবসায়ী মাঈন উদ্দীন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামগতি পৌরসভার উপসহকারি প্রকৌশলী রিফাত জানান, দু পক্ষ পূর্ব পরিচিত হওয়ায় আমি কেবল বেচা-বিক্রির তথ্যটি আদান-প্রদান করেছি। এগুলো চোরাইকৃত পাথর কিনা আমার জানা ছিল না।
বিশ্বাস কন্সট্রাকশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার মোজাম্মেল হক বলেন, আমি ঢাকায় আছি। কাজের ধীরগতির কারণে স্থানীয় লোকজন হয়তো এমন সন্দেহ করছে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা সম্পুর্ন ভিন্ন। এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে তিনি অনুরোধ জানান। পাথরভর্তি ৩টি গাড়ী আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রামগতি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: মোসলেহ উদ্দিন। লক্ষ¥ীপুর পানি উন্নয়ন নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ্জামান জানান, বিষয়টি সম্পূর্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপার। আমরা তাদেরকে কাজ দিয়েছি। আবার কাজ বুঝে নিবো, এটাই বাস্তবতা। এখন শুনেছি ঠিকাদারের লোকজন নদী বাঁধের জন্য আনা পাথর অন্যত্র বিক্রি করেছে। এবং পুলিশ গাড়ীগুলো আটক করছে। রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন, খবর পেয়ে আমরা সাথে সাথে পাথরসহ গাড়ীগুলো আটক করি। বর্তমানে পাথরসহ গাড়ীগুলো থানা হেফাজতে রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২১সালে মেঘনা তীর সংরক্ষন বাঁধ প্রকল্পের আওতায় রামগতি-কমলনগর উপজেলা ৩১কিলোমিটার বেড়ীবাঁধের জন্য ৩হাজার ১শ কোটির টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। ওই বছরই প্রকল্পটির কাজ উদ্বোধন করেন তৎকালীন সাংসদ মেজর (অব) আবদুল মান্নান। শতাধিক ঠিকাদারের মাধ্যমে ৪৩টি পয়েন্টে বেড়ীবাঁধের কাজ শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি উদ্বোধন হওয়া পাটোয়ারী বাড়ি পয়েন্টর ৭শ মিটার কাজের। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

 

আরও পড়ুন